আপনার শখের বাগান পরিবেশের ক্ষতি করছে কি?
মানুষ মাত্রই সৌন্দর্যের ভক্ত। ফুল-পাখি, লতাপাতা কার না ভালো লাগে? এ ভালো লাগা থেকেই আমরা আমাদের এলাকা, সমাজ বা বাসা বাড়ির আশেপাশে গাছ লাগাই। শুধু সৌন্দর্যের জন্য গাছ লাগাই তা নয়। তবে সৌন্দর্য একটি বড় নিয়ামক। তাছাড়া নগরায়ণের যুগে যেখানে এক টুকরো জায়গা পাওয়াটাই চ্যালেঞ্জ, সেখানে বনায়নের জন্য শহুরে বাসা বাড়িতে গাছ লাগানোটা এক প্রকার বিলাসিতা বলা যায়। কিন্তু তা বলে কি আমরা বসে থাকি?
এডিনিয়াম © লেখক |
আমাদের শহুরে বাসার বেলকনি বা ছাদে ফুল বা ফলের গাছের দেখা পাওয়া এখন স্বাভাবিক বিষয়। কিছু না হলেও প্লাস্টিকের বোতলে দু একটা লতাপাতা তো দেখাই যায়। কেউবা ছাদেই রীতিমতো তৈরি করে ফেলি সবজি বা ফলের বাগান। অনেককে তো বাণিজ্যিক নার্সারিও ছাদে বানাতে দেখা যায়।
এডিনিয়াম © লেখক |
আমাদের শখের এ গাছগুলোর যত্নের যেন অভাবে না হয় সেদিকে আমাদের থাকে অনেক মনোযোগ। কিন্তু আমাদের শখের এ বাগান গুলো আমাদের পরিবেশের ক্ষতি করছে কি?
আমরা গাছের রোগ বালাই নিরসনে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি। কারো অজানা নয় যে এ সকল কীটনাশক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের ছাদ বাগানে ব্যবহৃত কীটনাশক কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে?
১. কীটনাশক সাধারণত নির্দিষ্ট কোন একটি প্রাণীর উপর কার্যকর নয়। এটা সামগ্রিক ভাবে সকল পতঙ্গ বা নির্দিষ্ট একটা গ্রুপের উপর কার্যকর। তাই ক্ষতিকর পোকা নিধন করতে গিয়ে আমরা অনেক উপকারী পোকা যেমন: মৌমাছি বা অপুরূপ সৌন্দর্যের প্রজাপতি মেরে ফেলি কিংবা বাগান উপকারী পতঙ্গের চলাফেরা করার অনুপযোগী করে ফেলি। ফুল ফোঁটার পর ভোমরা না আসলে বাগান কি কখনো পূর্নতা পায়?
তাছাড়া ঢাকা সহ বড় শহর গুলোতে আমাদের বেলকনি বা ছাদের বাগান গুলোই অনেক প্রাণীর প্রধান আশ্রয়। তাদের কেউ তো বাঁচতে দিতে হবে। ঢাকা শহরের অনেক বেলকনিতে পাখির বাসা বাঁধা বা ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করা এখন নরমাল ঘটনা হয়ে গেছ।
২. কীটনাশক সহ সকল রাসায়নিক পদার্থ পানির সাথে ধুয়ে ড্রেন হয়ে নদী বা জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক পরিবেশে গিয়ে কীটনাশক বাস্তুতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দায়। এটা আর কারো অজানা নয়। তবে যে বিষয়টা এখনো সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছেনি সেটা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজেস্টান্সি।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজেস্টান্সি কী?
অ্যান্টিবায়োটিক শব্দটার অর্থ আমরা সবাই জানি ও বুঝি। সহজ ভাবে বললে যে সকল পদার্থ জীবাণু প্রতিহত করে তারাই অ্যান্টিবায়োটিক। অ্যান্টিবায়োটিক পদার্থের ক্রিয়াতে জীবাণু কাবু হয়ে যায়। তবে নির্দিষ্ট জীবাণুর সব সদস্যকে কাবু করতে নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিকের নির্দিষ্ট মাত্রা বা কোর্স ফলো করতে হয়। কোর্স ফলো না করলে দেখা যায় সে জীবাণুর সকল সদস্য কাবু হয় না। কিছু সদস্য বেঁচে যায়। এই বেঁচে যাওয়া সদস্যরাই পরবর্তীতে ঝামেলা পাকায়। এরা এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে অভিযোজিত হয়ে যায় যার কারণে এদের কাবু করতে পূর্বের তুলনায় এন্টিবায়োটিকের মাত্রা বা কোর্স বৃদ্ধি করতে হয়। জীবাণুর এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া বা অভিযোজিত হওয়াকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি বলে। এজন্য ডাক্তার আমাদের যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক না খাবার পরামর্শ দেন এবং কোর্স কমপ্লিট করতে বলেন।
বাগানে ব্যবহৃত এ্যান্টিবায়োটিক বা কীটনাশক শুধু আমাদের বাগানের রোগ-বালাই বা পোকামাকড়কেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট করছে না, বরং প্রাকৃতিক জলাশয়ে গিয়েও সেখানে এ সমস্যা সৃষ্টি করছে। এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে গাছের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়।
১৯৩৯ সালে DDT (একটি রাসায়নিক কীটনাশক) কে কীটনাশক হিসেবে আবিষ্কার করার ফলে কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয় এমন কি এটাকে ঘরের ফ্লোরেও দেয়া হতো রোগ জীবাণু ও মশা-মাছি প্রতিহত করতে। এ দারুণ আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে রসায়নবিদ পল হ্যারমান মুলার কে নোবেল দেয়া হয়। কিন্তু পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাবের জন্য এখন বিশ্ব ব্যাপী DDT নিষিদ্ধ।
৩. কীটনাশক ব্যবহারে আমাদের স্বাস্থ্যের যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমরা শাক-সবজি বা খাদ্য দ্রব্য কেনার সময় খুবই চিন্তিত থাকি কীটনাশক বা প্রিজারভেটিভ নিয়ে। কিন্তু আমাদের শখের ফুল বাগানে কীটনাশক দিতে অনেকেই ইতস্তত করিনা।
তাহলে আমরা গাছের রোগ-বালাই হলে কী করবো?
ঘরোয়া উপায়েই কিন্তু আমরা গাছপালার অনেক রোগ জীবাণুর দাওয়া তৈরি করতে পারি।
কেমিক্যাল মুক্ত বাগান গড়তে কিছু টিপস:
- সংক্রমিত অংশ বেশি না হলে হাত দিয়ে পরিষ্কার করা। যেমন: মিলি বাগ বেশি না হলে প্রথমেই এদের একটি একটি করে মেরে ফেলা সম্ভব।
- গাছের রোগাক্রান্ত অংশ বেশি হয়ে গেলে গাছে কীটনাশক স্প্রে না করে সংক্রমিত অংশ বা ডালটি কেটে ফেলা।
- কৃত্রিম রুট হরমোনের প্রকৃতির বিকল্প এলোভেরা যা আজকাল সহজলভ্য এবং অনেকের ছাদ বাগানেই থাকে।
- রান্নার গুড়া হলুদ প্রাকৃতিক ছত্রাকনাশক।
- ডিটারজেন্ট বা সাবান পানি দিয়ে অনেক পোকামাকড় দূর করা যায়।
- অনেক সবজির ক্ষেত্রে কাঠ কয়লার ছাই ব্যবহারে গান্ধী পোকার উপদ্রব থেকে উপকার পাওয়া যায়।
- রাসায়নিক সারের উত্তম বিকল্প গোবর বা কম্পোস্ট। রাসায়নিক সার ব্যবহারে সাময়িক উপকার পেলেও এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। রাসায়নিক সার মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে ফেলে। বাসা বাড়িতে পেঁয়াজ-রসুন, বা শাক-সবজির পরিত্যক্ত অংশ দিয়ে সহজেই কম্পোস্ট বানিয়ে ফেলা সম্ভব।
এডিনিয়াম © লেখক |
আমাদের শারীর ও পরিবেশের স্বাস্থ্য সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে আমাদের শখের বাগানে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারে যত্নবান হতে হবে।
আমাদের নিজেদের জন্য।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
- Azizul Islam Barkat
Comments
Post a Comment